ডায়াবেটিসের এমন ১০টি উপসর্গ আছে যা সম্পর্কে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষদের অনেকেই জানেন না। ডায়াবেটিসের কিছু উপসর্গ শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়। এ প্রতিবেদনে পুরুষদের ডায়াবেটিসের ১০ উপসর্গ উল্লেখ করা হলো।
১. ত্বকে কালো দাগ হয়: আপনার ভিতরকার স্বাস্থ্যের জানালা হচ্ছে, আপনার ত্বক। ত্বকে প্রকাশিত সব ধরনের লক্ষণের ব্যাপারে সচেতন থাকুন। ডায়াবেটিসের লক্ষণও ত্বকে প্রকাশ পেতে পারে। আপনার গলার পেছনে, কুঁচকি কিংবা বগল নোংরা দেখাতে পারে, কিন্তু এসব স্থানে ডার্ক প্যাচ বা কালো দাগ বা কালো আবরণ প্রকৃতপক্ষে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের উপসর্গ। একে অ্যাকেনথোসিস নিগ্রিকেন্স (এএন) বলে। এন্ডোক্রাইন সোসাইটির অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড পাবলিক আউটরিচ কোর কমিটির চেয়ারম্যান, নিউ ইয়র্ক সিটির সেন্ট জোসেফ’স কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং সার্টিফায়েড ডায়াবেটিস এডুকেটর মারগারেট ইকার্ট-নরটন বলেন, ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হরমোনও ত্বকের লক্ষণে অবদান রাখে বলে ধারণা করা হয়।’ তিনি যোগ করেন, এটি (অ্যাকেনথোসিস নিগ্রিকেন্স) এমন কিছু যা ধীরে ধীরে কয়েক বছর ধরে বিকশিত হওয়ার প্রবণতাযুক্ত।’ অ্যাকেনথোসিস নিগ্রিকেনসের চিকিৎসা এর মূল কারণ চিহ্নিতকরণের সঙ্গে জড়িত- এক্ষেত্রে রক্ত শর্করার মাত্রার উপর নিয়ন্ত্রণ পুনরায় অর্জন করতে হবে।
২. পেনিসের অগ্রভাগ লাল ও স্ফীত হয়: আপনার যে টাইপ২ ডায়াবেটিস আছে তা জানান দিতে অনেক সতর্কীকরণ উপসর্গ রয়েছে, যেমন- ইরেক্টাইল ডিসফাংকশন বা লিঙ্গ উত্থিত না হওয়া। যখন আপনার অনিয়ন্ত্রিত রক্ত শর্করা থাকবে, আপনি ব্যালানাইটিসের ঝুঁকিতে থাকবেন। পেনিসের অগ্রচর্ম ও অগ্রভাগ ফুলে যাওয়াকে ব্যালানাইটিস বলে। এর ফলে ব্যথা হতে পারে, অথবা ডিসচার্জ হতে পারে। আপনার প্রস্রাবের রক্ত শর্করা ব্যাকটেরিয়া ও ইস্ট জন্মানোর জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। আপনার ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন, যিনি আপনাকে এ জায়গা পরিষ্কার রাখার সর্বোত্তম উপায় বলে দিবেন এবং চিকিৎসা হিসেবে কোন অ্যান্টি-ফাঙ্গাল বা অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম রিকমেন্ড করতে পারেন।
৩. শেভিং ক্ষত দ্রুত সারে না: আপনার মুখে শেভিং করার সময় সৃষ্ট ক্ষুদ্র ক্ষত সেরে ওঠতে দেরি হলে তা ডায়াবেটিসের লক্ষণ হতে পারে। ইকার্ট-নরটন বলেন, ‘আপনার শর্করা ক্ষতস্থানে আসার ফলে ক্ষত সেরে ওঠতে বিলম্ব হয়।’ আপনার দাড়ির গ্রন্থিকোষের জায়গায় আপনি শেভিং বাম্প এবং হোয়াইট হেডও লক্ষ্য করতে পারেন। ইকার্ট-নরটন বলেন, ‘যখন আপনার টাইপ২ ডায়াবেটিস থাকবে, আপনার মুখের তৈল গ্রন্থিও লো-গ্রেড ইনফেকশনের কারণ হবে।’
৪. হাত ও পায়ে ব্যথা ও অসাড়তা হয়: টাইপ২ ডায়াবেটিসের অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে নার্ভ ড্যামেজ, যাকে পেরিফেরাল ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি বলে। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ‘আপনি রণন অনুভব করতে পারেন, অথবা পায়ে পিন ও সুঁচ বিদ্ধ হওয়ার মত যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেন, কিংবা ব্যথা, অসাড়তা ও দুর্বলতা অনুভব করতে পারেন।’ এসব অনুভূতি প্রথমদিকে পায়ে হলেও পরবর্তীতে হাতেও হতে পারে। ব্যথা এবং অসাড়তা হ্রাস করতে রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
৫. খুব তৃষ্ণা পায়: টাইপ২ ডায়াবেটিসের কমন উপসর্গ হচ্ছে তৃষ্ণা পাওয়া, প্রকৃতপক্ষে এটি অন্তত ৮টি মেডিক্যাল সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে পানি খাওয়ার পরও আপনার তৃষ্ণা নিবারণ হচ্ছে না। ইকার্ট-নরটন বলেন, ‘রক্ত শর্করার মাত্রা বৃদ্ধির কারণে এরকম হচ্ছে, যা অতিরিক্ত শর্করা বের করে দেওয়ার জন্য কিডনিকে চাপ প্রদানের মাধ্যমে অধিক প্রস্রাব উৎপাদনের ফল।’ অধিক প্রস্রাব উৎপাদন হলে আপনি বেশি করে মূত্রত্যাগ করবেন, যা আপনাকে ডিহাইড্রেশনের দিকে ধাবিত করবে এবং আপনি বেশি করে পানি পান করতে চাবেন। যদি আপনি ঘনঘন প্রস্রাব করেন কিংবা অধিক তৃষ্ণা অনুভব করেন, তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
৬. চোখে ভাসন্ত কালো বিন্দু দেখা যায়: অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস চোখের ক্ষতি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আই ইনস্টিটিউটের মতে, ‘উচ্চ রক্ত শর্করা রেটিনায় রক্তনালীর ক্ষতি করে রক্তপাত ঘটায় এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির দিকে ধাবিত করে।’ আপনার দৃষ্টির সামনে ব্ল্যাক ফ্লোটিং স্পট বা ভাসন্ত কালো বিন্দু লক্ষ্য করতে পারেন এবং আপনার দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে। আপনার মধ্যে টাইপ২ ডায়াবেটিসের এসব লক্ষণ দেখা দিলে সম্পূর্ণ চক্ষু পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের কাছে যান। চোখের সুস্থতা নিশ্চিত করতে আপনার প্রতিবছর অন্তত একবার চক্ষু পরীক্ষা করা প্রয়োজন হবে।
৭. ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়: আপনার ব্যাখ্যাতীত খুব ক্ষুধা পেলে তা হতে পারে টাইপ২ ডায়াবেটিসের উপসর্গ। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের মানে হচ্ছে শরীরের কোষে শর্করা পৌঁছানো কঠিনতর হয়ে যাওয়া, যেখানে এটি শক্তি উৎপাদন করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আপনার শরীর অধিক ইনসুলিন উৎপাদন করে এবং এটি আপনার ক্ষুধা জোরদার করে ও আপনার মধ্যে খাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপিত করে। ইকার্ট-নরটনের মতে, এভাবেও ওজন বৃদ্ধি পায়। তিনি যোগ করেন, কিছু রোগী ডেস্কে ক্যান্ডি বার রাখে, যখন তারা নিম্ন রক্ত শর্করা অনুভব করে তখন তারা ক্ষুধা নিবারণে তা খায়। সমস্যা হচ্ছে তারা অত্যধিক খাওয়া এবং অনুপযুক্ত ধরনের খাবারের (যেমন- ক্যান্ডি বার) দিকে ঝুঁকে যা শরীরের জন্য ভালো নয়।
৮. মেজাজ খারাপ হয়: নিম্ন রক্ত শর্করা দ্বারা উদ্দীপিত সমস্যাসমূহের মধ্যে বেশ পরিচিত একটি সমস্যা হচ্ছে, মুড ডিসঅর্ডার বা মেজাজ খারাপ হওয়া। ২০১২ সালে ডায়াবেটোলজি অ্যান্ড মেটাবলিক সিন্ড্রোমে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, যেসব পুরুষের টাইপ২ ডায়াবেটিস ছিল তাদের মেজাজ সুস্থ পুরুষদের চেয়ে বেশি বিষণ্ন ছিল। খোশমেজাজ বজায় রাখার জন্য রক্ত শর্করার ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ। যখন ভারসাম্যের পতন হয়, নিম্ন রক্ত শর্করা মেজাজকে খিটখিটে বা খারাপ করতে অবদান রাখতে পারে।
৯. মাড়ি থেকে রক্ত ঝরে: মৌখিক স্বাস্থ্যবিধির শীর্ষে থাকার একটি কারণের কথা হয়তো আপনি শুনে থাকবেন, এটি হচ্ছে- মাড়ির সমস্যা আপনাকে হৃদরোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকিতে রাখতে পারে। আপনার দাঁত আপনার শরীরের অনেক সমস্যার কথা প্রকাশ করতে পারে এবং তাদের একটি হচ্ছে ডায়াবেটিস। মাড়ির রোগ হচ্ছে পুরুষদের ডায়াবেটিসের একটি উপসর্গ। যেসব লোকদের ডায়াবেটিস আছে তাদের মধ্যে পিরিয়ডোনাইটিস (একটি ইনফেকশন যা মাড়ির ক্ষতি ও দাঁত ক্ষয়ের কারণ) বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ডায়াবেটিস না থাকা লোকদের তুলনায় তিনগুণের বেশি। মাড়ি লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া এবং মাড়ি থেকে রক্তপাত হওয়া হচ্ছে পিরিয়ডোনাইটিসের কয়েকটি লক্ষণ। এরকম হলে ডেন্টিস্টকে দেখানো খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং একে নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত। এই ইনফেকশন অন্যভাবেও কাজ করতে পারে এবং রক্ত শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে।
১০. মাথা ঝিমঝিম করে বা মাথা ঘোরে: যখন আপনি ডায়াবেটিসের সম্ভাব্য উপসর্গের কথা চিন্তা করবেন, আপনার মনে মাথা ঝিমঝিম করা বা মাথা ঘোরার বিষয়টি নাও আসতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ডায়াবেটিসের একটি উপসর্গ এবং কমপক্ষে ৮টি মেডিক্যাল কারণে আপনার মাথা ঝিমঝিম করতে পারে বা মাথা ঘুরতে পারে। আর্কাইভস অব ইন্টারনাল মেডিসিনের ২০০৯ সালের এক গবেষণামতে, ‘ইনার ইয়ার ডিসঅর্ডার (যা মাথা ঝিমঝিম করা বা ঘোরা ও মাথার ভারসাম্যহীনতা হিসেবে দেখা দিতে পারে) টাইপ২ ডায়াবেটিস না থাকা লোকদের তুলনায় টাইপ২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ বেশি ছিল।’ ডায়াবেটিস ক্ষুদ্র রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যে কারণে কানের ভিতরের স্ট্রাকচারে রক্তপ্রবাহ বিঘ্নিত হয়।
ডায়াবেটিস দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে
ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর প্রভাব মাথা থেকে পা পর্যন্ত সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর পড়ে। বেশি আক্রান্ত হয় চোখ, দাঁত, হৃদযন্ত্র ও কিডনি। এছাড়া যৌন সমস্যা দেখা দেয়। পর্যায়ক্রমে শরীরের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। প্রথমে ব্যথা, পরে অবশ, আস্তে আস্তে ঘা, শেষে পা কেটে ফেলতে হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অবস্থায় গর্ভধারণ করলে মা এবং শিশু উভয়ই সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিসের নানা জটিলতা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কথা বলেছেন ডায়াবেটিস, হরমোন ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল জলিল আনসারী।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস কী?
উত্তর : ডায়াবেটিস হচ্ছে বহুমূত্র রোগ। প্রাচীন ভারতে এটাকে মধুমেহ বা বহুমূত্র রোগ বলা হতো। মধু মানে মিষ্টি আর মেহ মানে প্রস্রাব। প্রস্রাবের সাথে যেহেতু মধু জাতীয় মানে মিষ্টি জাতীয় জিনিস যাচ্ছে সে কারণে মধুমেহ বলত। ঘন ঘন প্রস্রাব হবে, প্রস্রাবের সাথে সুগার যাবে, শরীর শুকিয়ে যাবে- এই তিনটাকে একত্রে বলে ডায়াবেটিস। পুরো নাম ডায়াবেটিস ম্যালাইটাস। আমরা শুধু ডায়াবেটিস বলি। ডায়াবেটিস হলে শরীরে ইনসুলিনের অভাব দেখা দেয়। ইনসুলিন কমে গেলে শরীরের অনেক ক্ষতি হয়।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের ক্ষতি হয়?
উত্তর : ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর প্রভাব মাথা থেকে পা পর্যন্ত সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গের ওপর পড়ে। বেশি আক্রান্ত হয় চোখ, দাঁত, হৃদযন্ত্র ও কিডনি। এছাড়া যৌন সমস্যা দেখা দেয়। ডায়াবেটিস একসাথে দুই চোখকেই আক্রান্ত করে। চোখ আক্রান্ত হওয়াকে আমরা ডায়াবেটিক আই ডিজিজ বা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বলি। রেটিনা হচ্ছে চোখের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। এটি একবারে নষ্ট হয় না। আস্তে আস্তে নষ্ট হয়। ধীরে ধীরে তা অন্ধত্ব পর্যন্ত নিয়ে যায়। রেটিনা নষ্ট হলে চোখের কার্যকারিতা থাকেই না। এছাড়া ছানি পড়ে, চোখে বেশি বেশি ইনফেকশন হয়।
মুখের বেলায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে দাঁতের অসুখ বেশি হয়। যাকে ডেন্টাল ক্যারিজ বলা হয়। দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া। দাঁতের গোড়ার চারদিকে ইনফেকশন হয়ে যায়। ক্রামন্বয়ে একটার পর একটা দাঁত নষ্ট হতে থাকে। দাঁত ফেলে দিতে হয়। তাছাড়া মুখে অনেক ইনফেকশন হয়। হার্ট সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের হার্টের অসুখ দুই থেকে তিন গুন বেশি। এমনকি যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদেরও হয়। প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা হার্ট অ্যাটাক বলি, সেই হার্ট অ্যাটাক এবং হার্টের ব্যথা ডায়বেটিক রোগীদের অনেক বেশি। নিয়ন্ত্রণে রাখলে বেশি হয় না।
ডায়বেটিসের কারণে কিডনিতে বড় ধরনের অসুখ হয়। এটাকে ন্যাবোপ্যাথি বলা হয়। ডায়াবেটিক রোগীদের দুটা কিডনিই একই সাথে আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে একসময় কর্মক্ষমতা থাকেই না। এ অবস্থাকে আমরা বলি চূড়ান্তভাবে কিডনি অকার্যকর হয়ে যাওয়া। তখন কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয় বা ডায়ালাইসিস করতে হয়। তা না হলে বেঁচে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। চূড়ান্তভাবে কিডনি ফেইলার হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে কিডনি রোগ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
আরেক ধরনের জটিলতা আছে। এটাকে বলা হয় নিউরোপ্যাথি (নার্ভের সমস্যা)। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস পর্যায়ক্রমে শরীরের সমস্ত স্নায়ু সিস্টেমকে আক্রান্ত করে। প্রথমে ব্যথা, পরে অবশ, আস্তে আস্তে ঘা, শেষে পা কেটে ফেলতে হয়। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা অনেক।
প্রশ্ন : ডায়বেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নিয়ে আমাদের দেশে কোনো জরিপ আছে কি?
উত্তর : আনুমানিক ৮০ লাখের মতো ডায়াবেটিস রোগী আছে। অর্ধেক নারী, অর্ধেক পুরুষ। এর মধ্যে অর্ধেকই জানেন না, তাদের ডায়াবেটিস আছে।
প্রশ্ন : এই সমস্যা মোকাবেলায় কী করা প্রয়োজন?
উত্তর : ডায়াবেটিসের প্রথম অবস্থায় তেমন কোনো উপসর্গ না থাকায় কেউ ডাক্তারের কাছে যায় না। সে কারণে প্রথমে রোগ ধরা পড়ে না। প্রথম দিকে জানতে পারলে খুবই ভালো হয়। সেজন্য জনসচেতনার বিকল্প নেই। জনসচেতনতা শুধু যে চিকিৎসকরা করতে পারবেন, তা নয়। মিডিয়া ও জনগণের সাথে যারা জড়িত তারাও যদি জনগণকে পরীক্ষার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে মানুষ আগ্রহের সাথে পরীক্ষা করবে। এটার পরীক্ষা করা সহজ। অধিকাংশ কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকে পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। অনেকে হয়তো জানেন না ।
প্রশ্ন : গর্ভবতী নারীদের কী ধরনের সমস্যা হয়?
উত্তর : মহিলাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস অবস্থায় গর্ভধারণ করলে মা এবং শিশু উভয়ই সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। গর্ভপাত থেকে শুরু করে শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে।
প্রশ্ন : গর্ভাবস্থায় কি ডায়বেটিস হতে পারে?
উত্তর : হ্যাঁ। গর্ভের সময় হয়। আবার বাচ্চা প্রসবের পরে সেরে যায়। এটাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। এটারও স্কিনিং করা দরকার। জটিলতা দেখা দিলে, সন্তান না হলে, মৃত সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তখনই এটা নজরে আসে। তাই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে গর্ভকালীন ২৪ সপ্তাহে বা তার পরে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করলে ভালো হয়। গর্ভের আগে ও গর্ভাবস্থায় এই পরীক্ষাটা করিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সচেতনতার অভাবে এটা করেন না।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিসের আক্রান্ত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বয়স আছে ?
উত্তর : মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেকোনো সময় ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকার : টাইপ-১ এবং টাইপ-২। টাইপ-১ এ আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে তা ৫ শতাংশ। টাইপ-১ সাধারণত ১০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। আর টাইপ-২ হয়ে থাকে ২৫ বছরের পর থেকে। যত বয়স বাড়তে থাকে তত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। টাইপ-১ হলে ইনসুলিন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তার চিকিৎসা করা যায় না।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা ভালো কেন ?
উত্তর : ডায়াবেটিস মূলত ইনসুলিনের অভাবজনিত রোগ। ইনসুলিনের অভাব হলেই ডায়াবেটিস হয়। তাই ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা করা যুক্তিসংগত।
প্রশ্ন : ডায়বেটিসের জন্য খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন পদ্ধতি কতটা দায়ী?
উত্তর : অত্যন্ত বেশি দায়ী। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারী আকারে ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। অনেক লোকের একসাথে হলে তাকে মহামারী বলা হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। জীবনযাপন পদ্ধতির পরবির্তনের কারণে যাদের ৭০ বছরে হওয়ার কথা, তাদের ৩০ বছরেই হচ্ছে। মুটিয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ, শুধু বসে বসে কাজ করা, শরীরচর্চা-পরিশ্রম ও খেলাধুলা না করার কারণে ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। মানসিক চাপ মানুষের ডায়াবেটিস বাড়ায় কি না, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। তবে আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, অতিরিক্ত মানসিক চাপ ডায়াবেটিস হওয়ার একটা কারণ হতে পারে। ঘুমের সাথে কেউ কেউ ডায়াবেটিসের সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছেন। তা হলো কম ঘুমানো। মানুষের অন্তত ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। কম ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিসের কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে?
উত্তর : অনেকদিন আগের একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, ডায়বেটিসের চিকিৎসার জন্য যদি ১ টাকা ব্যয় করা হয় তাহলে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ৬৭ টাকা লাভ হবে। কারণ, ডায়াবেটিস-জনিত কারণে মানুষের পঙ্গুত্ব হবে না, অন্ধত্ব হবে না, কর্মক্ষমতা হ্রাস পাবে না- এ ধরনের একটা হিসেব হয়েছিল। আমার ধারণা, বর্তমানে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ১ টাকা ব্যয় করলে রাষ্ট্রের ১০০ টাকা লাভ হতে পারে। মানুষের কর্মক্ষম বয়সে ডায়াবেটিস হয়। যে কারণে অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর অনেক বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
প্রশ্ন: সচেতন করতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন? আপনি জানেন যে, নভো নরডিস্ক অনেক সচেতনতামূলক কাজ করে থাকে। এগুলো যথেষ্ট কি না?
উত্তর : সচেতনার জন্য জনগণকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। যাদের বংশে ডায়াবেটিস নেই বা হয়নি, তাদের হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। তাদের ক্ষেত্রে ৪০ বছরের পর থেকে শুধু চেকাপ করাই যথেষ্ট। যাদের পরিবারে বা নিকট আত্মীয়ের আছে, তাদের পরিবারের সদস্য বা সন্তানের হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তাই তাদের ২৫ বছরের পর থেকে ২ বছর বা ৫ বছর অন্তর পরীক্ষা করা দরকার। আর তৃতীয়ত, যাদের ডায়াবেটিস হয়ে গেছে, তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : ইনসুলিন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গুণগত মান বজায় রাখার জন্য ইউএসএফডিএ এবং ইএমএর নীতিমালা কতটা প্রয়োজন?
উত্তর : প্রথম দিকে প্রাণীদেহ থেকে সংগ্রহ করা হতো। তাতে এলার্জি ছিল। সেই ইনসুলিন গ্রহণ করা ততটা সুখকর ছিল না। যদিও তাতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকত। ইনসুলিন তৈরির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মানের অনেক অনেক উন্নতি হয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো সারা পৃথিবীতে ইনসুলিনকে উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছে। গুণগত মানে নেওয়ার খুবই সুস্থ একটা প্রতিযোগিতা আছে। যার ফলে এর গুণগত মান বেড়ে যাচ্ছে। নভো নরডিস্ক ও অন্যান্য কোম্পানি মানসম্মত ইনসুলিন বাজারজাত করেছে। গুণগত মান দেখার জন্য মান নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট বা মতামতের খুবই গুরুত্ব আছে। আমরা বেশিরভাগই তাদের অনুসরণ করে থাকি।
প্রশ্ন : বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের আলোকে চিকিৎসাসেবা রোগীদের মৌলিক অধিকার- এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করুন।
উত্তর : যেসব রোগের চিকিৎসা আছে, রোগীরা সেসব রোগের চিকিৎসা পাবে এটা আমরা বিবেচনা করি। স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকার। তাই বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের আলোকে রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
কমেন্টস করুন