গরমে হাঁপ ধরে যায় বড়দেরই; ছোট্ট শিশুর নরম তুলতুলে শরীরটা পারবে তো এ পরিবর্তন সামলাতে? এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তোফাজ্জল হোসেন খান বলেন, এই সময় নবজাতকের ত্বকে ও নাভিতে জীবাণুর সংক্রমণ হয়ে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়। গরমের সময় খুশকির সমস্যাও হতে পারে। এ ছাড়া বছরের যেকোনো সময়ই নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ছোট্টমণির অসুখ করলে বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান, এটাই তো স্বাভাবিক। তবে ঘাবড়ে না গিয়ে কী কী ব্যবস্থা নিলে শিশু দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে, তাই জানালেন তোফাজ্জল হোসেন খান।
হঠাৎ জ্বর হলে জন্মের দুই থেকে তিন দিন পার হওয়ার পর হঠাৎ জ্বর আসতে পারে। সাধারণত এ সময় ‘ডিহাইড্রেশন ফিভার’ হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এ সময়ে মায়ের দুধের পরিমাণ একটু কম থাকে, তাই শিশু একটু কম খাবার পায়। এ কারণেই জ্বরটা হয়ে থাকে। এ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। এক-দেড় দিন পর শিশু স্বাভাবিকভাবে দুধ পেতে থাকলে জ্বর ভালো হয়ে যায়। তবে জ্বর এলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এটি সাধারণ জ্বর না কোনো সংক্রমণের কারণে জ্বর হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। জীবাণুর সংক্রমণ হয়ে থাকলে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
জন্মের ৭-১৫ দিন পর জ্বর এলে শিশুর শরীর মুছিয়ে দিয়ে মাথায় একটু পানি দিতে পারেন। তবে একেবারে ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া নবজাতকের উপযোগী চার থেকে পাঁচ ফোঁটা প্যারাসিটামল ড্রপ দিতে পারেন। এরপর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
তবে যেকোনো নবজাতক যদি স্বাভাবিক খাওয়া বন্ধ করে দেয় বা ওর নড়াচড়া কমে যায়, তাহলে অতিসত্বর শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
নিউমোনিয়া নিউমোনিয়া হলে শিশুর শ্বাস টানতে কষ্ট হয়, শিশু ঘন ঘন শ্বাস নেবার কারণে পাঁজরের নিচের অংশ দেবে যায়। এই সময় জ্বর থাকতেও পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। এ ধরনের যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
নাভিতে সংক্রমণ নাভি ফুলে গিয়ে এর চারপাশ লাল হয়ে গেলে, নাভি থেকে পুঁজ পড়লে বা দুর্গন্ধ ছড়ালে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দেরি করবেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অ্যান্টিসেপটিক দ্রবণ ও অয়েনমেন্ট ব্যবহার করার মাধ্যমে চিকিৎসা করা সম্ভব হলেও কিছু ক্ষেত্রে ইনজেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিতে হতে পারে। তাই আপনার সোনামণির কোন ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন, তা জেনে নিন।
খুশকি হলে নবজাতকের খুশকি হলে ছত্রাকরোধী শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। ২ শতাংশ কিটোকোনাজল শ্যাম্পু কিনতে পাওয়া যায়। এ শ্যাম্পু সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন ব্যবহার করতে হবে এবং এক থেকে দুই মাস পর্যন্ত অবশ্যই ব্যবহার চালিয়ে যেতে হবে। দু-একবার ব্যবহারে খুশকি ভালো হয়ে গেলেও এক থেকে দুই মাস পর্যন্ত তা চালিয়ে যেতে ভুলবেন না। তবে এরপরেও সমস্যা না মিটলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মাসি-পিসি এল বাড়ি জন্মের দুই বা তিন দিন পর নবজাতকের ত্বকে র্যাশ উঠতে দেখা যায়। একে সাধারণভাবে মাসি-পিসি বলা হয়। এটি হাম নয়, বরং এটি অ্যালার্জির কারণে হওয়া একধরনের র্যাশ। কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ র্যাশ ভালো হয়ে যায়। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
আরও র্যাশ? শিশুর ত্বকে র্যাশ হলে গোসল দেওয়া থেকে বিরত থাকার প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক নিয়মেই তাকে গোসল দেওয়া যাবে। ডায়াপার ব্যবহারের কারণে র্যাশ বেশি হয়ে থাকে বলে এর ব্যবহার এড়িয়ে চলা ভালো। তবে ত্বকে পুঁজ জমে থাকা ছোট ছোট গোটার মতো দেখা দিলে চিকিৎসা নিতে দেরি করবেন না। দেরি করলে সংক্রমণ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
এসব সমস্যা এড়াতে কিছু বিষয়ে বাড়তি খেয়াল রাখা প্রয়োজন বলে জানালেন অধ্যাপক ডা. তোফাজ্জল হোসেন খান-
১. জন্মের পরই শিশুকে শালদুধ খেতে দিতে হবে। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া অন্য কোনো কিছুই দেওয়া যাবে না; এমনকি পানিও নয়। মধু বা প্রচলিত অন্য যেকোনো খাবার দেওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকুন। মায়ের দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কৌটার দুধ বা গরুর দুধ ছোট্ট শিশুর জন্য ক্ষতিকর। অনেকে মনে করেন শিশুর ওজন ঠিকভাবে বাড়ছে না; সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৬ বার প্রস্রাব করলে বোঝা যায়, শিশু যথেষ্ট দুধ পাচ্ছে। তবে ওজন কম মনে হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
২. নাভির সংক্রমণ এড়াতে জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ৭.১ শতাংশ ক্লোরহেক্সিডিন দ্রবণ শিশুর নাভিতে দিতে হবে। নরমাল ডেলিভারি হোক বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হোক না কেন, পরিণত-অপরিণত সব নবজাতকের জন্য এই দ্রবণ ব্যবহার করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে যেকোনো সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে এ দ্রবণ সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া শহর-গ্রাম সবখানেই ওষুধের দোকানে স্বল্পমূল্যের এই ওষুধ কিনতে পাওয়া যায়। এটি একবার লাগানোই যথেষ্ট। তবে নাভিতে লেগে থাকা বাড়তি দ্রবণ মুছে ফেলবেন না।
৩. জন্মের তিন দিনের মধ্যে গোসল করানো ঠিক নয়; বরং এক সপ্তাহ পর প্রথম গোসল করানো উচিত। পূর্ণ গর্ভকাল পেরোনো শিশুর ৩ দিন থেকে ১৫ দিন বয়স পর্যন্ত সপ্তাহে ১ দিন গোসল করানো ভালো। ১৫ দিন বয়স হয়ে গেলে গরমের সময়টায় তাকে প্রতিদিনই গোসল করানো যায়। আবার এক দিন পরপর করালেও ক্ষতি নেই। তবে পূর্ণ গর্ভকাল পার হয়নি, এমন নবজাতকদের সপ্তাহে এক থেকে দুই দিন গোসল করাতে হবে।
৪. জন্মের ১৫ দিনের মধ্যে তেল, লোশন, পাউডার না লাগানোই ভালো। এগুলো ত্বকে লেগে থেকে সংক্রমণের উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে।
৫. সপ্তাহে এক দিনের বেশি শ্যাম্পু করানোর প্রয়োজন নেই।
৬. জন্মের এক থেকে দুই মাস পেরোলে এরপর শিশুর চুল কাটানো উচিত। কোনোভাবেই এর আগে নয়।
রাফিয়া আলম
কমেন্টস করুন